বুধবার ২৬ নভেম্বর ২০২৫ - ১৬:৩৭
ফাতিমিয় মক্তব সত্যের পথে দৃঢ়তা ও ধৈর্যের আলো

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন হোসেইনি বলেছেন যে নিষ্কলুষ নিয়ত ও সম্পূর্ণ আন্তরিকতা—এ দুটিই ফাতিমিয় মক্তবের সর্বোচ্চ বৈশিষ্ট্য। তিনি উল্লেখ করেন, ফাতিমিয় ধারার সব গুণ–আচরণই মূল্যবোধ রক্ষায় ধৈর্য, সাহস ও স্থিরতার ওপর প্রতিষ্ঠিত; এবং ফাতিমি মক্তব হলো সত্যের পথে অবিচল থাকা ও ধৈর্যের এক জীবন্ত ফলাফল।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইরানের রাজধানী তেহরানের হযরত আব্দুল আজিম হাসনি (আ.)–এর পবিত্র মাজারে আয়াতুল্লাহ মুজতাহেদির মাদ্রাসার দায়িত্বপ্রাপ্ত হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মীর হাশেম হোসেইনি হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–এর মর্যাদা, তাঁর আন্তরিকতা এবং ফাতিমি ধারার শিক্ষাসমূহ নিয়ে বর্ণনামূলক আলোচনা করেন।

তিনি আল্লামা মাজলিসীর বিখ্যাত গ্রন্থ বিহারুল আনওয়ার–এর উল্লেখ করে বলেন, এটি আধ্যাত্মিক আলোয় ভরপুর এক মহাগ্রন্থ। এতে হুসেইন ইবনে রুহ—যিনি “গায়বাতে সুগরা” (ইমাম মাহদী (আ.ফা.)–এর সংক্ষিপ্ত গায়বাতের সময়কাল)-এ তাঁর বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন—তার একটি বাণী উদ্ধৃত আছে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর কি কেবল একটি সন্তান ছিল, নাকি একাধিক? তিনি জানান—নবী করিম (সা.)–এর একাধিক সন্তান ছিলেন এবং তাঁর সন্তানের সংখ্যা ৬ থেকে ৯টি পর্যন্ত নামসহ বর্ণিত হয়েছে—যেমন তায়্যিব, তাহের, আবুল কাসেম, ইবরাহিম, জয়নব বিনতে রাসুল (সা.), রুকেয়া বিনতে রাসুল (সা.) প্রমুখ।

এরপর হোসেইনি বলেন, প্রকৃত প্রশ্ন ছিল—সব সন্তান ও সহচরদের মাঝে কেন হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–ই ‘সমস্ত যুগের নারীদের সর্দার’ হওয়ার মর্যাদা লাভ করলেন? উত্তরে হুসেইন ইবনে রুহ বলেন—কারণ তাঁর অন্তর ছিল নিখাদ, নির্মল ও সম্পূর্ণ আল্লাহমুখী; তিনি জীবনের প্রতিটি কাজ শুধুই আল্লাহর জন্য করেছেন, তাঁর কথা, আচরণ ও অস্তিত্বের প্রতিটি দিক আল্লাহ ও আল্লাহর ওলির প্রতি নিবেদিত ছিল।

হোসেইনি বলেন, হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–এর মহিমা সাধারণ মানুষের বোধ দিয়ে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়—এটি মানব–বুদ্ধির বাইরে এক বিশাল মর্যাদা। তবে হুসেইন ইবনে রুহ প্রশ্নকারীদের সামর্থ্য অনুযায়ী সরল ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

তিনি সুরা কাওসারকে হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–এর প্রতি বিশেষভাবে নিবেদিত একটি সুরা হিসেবে উল্লেখ করেন এবং বলেন, এই ক্ষুদ্র সুরায় এমন ছয়টি শব্দ আছে, যা কুরআনের অন্য কোথাও ব্যবহৃত হয়নি—এ যেন তাঁর মর্যাদার জন্যই বিশেষভাবে নাজিল।

তিনি আরও বলেন, ইমাম আলী (আ.) ও হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–এর ঘরে সংঘটিত এক মহান ত্যাগ ও সৎকর্মের কারণেই সুরা “হাল আতা” (সুরা ইনসান/দাহর) অবতীর্ণ হয়। এই সুরায় ফাতিমি ধারার আটটি গুণাবলি উল্লেখ আছে।

হোসেইনি বলেন, হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) আল্লাহ ও মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতার পরিপূর্ণ উদাহরণ ছিলেন; তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে কৃতজ্ঞতার গুণ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠত।

তিনি ফাতিমিয় মক্তবের অনুসারীদের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে “অঙ্গীকার ও মানতের প্রতি বিশ্বস্ততা” উল্লেখ করেন, এবং বলেন—আহলে বাইত (আ.)–এর সত্যিকারের অনুসারীরা নিভৃতে থেকেও অন্যায়, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা থেকে বিরত থাকতেন; তাদের অন্তরের ঈমানি ভয় তাদেরকে ভুল থেকে রক্ষা করত।

তিনি আরও বলেন, ফাতিমিয় ধারার আনন্দ ছিল অন্যকে খাওয়ানোতে—নিজে ভোজনে নয়। এমনকি নিজেরা প্রয়োজন থাকা অবস্থাতেও অন্যকে খাদ্য দান করা—এটাই ছিল তাঁদের উঁচু মানসিকতার পরিচয়; যা সাধারণ দান–সদকার চেয়ে অনেক বড় ইবাদত।

তিনি উল্লেখ করেন, ফাতিমিয় মক্তব খাদ্য দানে কোনো গোত্র, দল বা জাতিগত বৈষম্য করত না। এমনকি কোনো অমুসলিম বন্দীও যদি হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–এর দরজায় আসত—তিনি কখনও হতাশ হয়ে ফিরতেন না।

হুজ্জাতুল ইসলাম হোসেইনি বলেন, নিয়তের পবিত্রতা—এটাই ফাতিমিয় মক্তবের চূড়ান্ত শিখর। এবং ফাতিমি ধারার সব গুণ, সব আচরণ, সব নৈতিকতা— সত্যের পথে ধৈর্য, স্থিরতা ও অবিচল থাকার মধ্যে এসবের মর্ম নিহিত।

তিনি বলেন, হুসেইন ইবনে রুহের ব্যাখ্যাও এই সত্যকে প্রতিফলিত করে—হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–এর মহান মর্যাদার মূল রহস্য তাঁর পরম আন্তরিকতা।

শেষে তিনি বলেন, আন্তরিকতা মানুষের হৃদয়ে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে; একটি অসৎ, দ্বিমুখী ও প্রতারণাপূর্ণ হৃদয় একটি পরিবার, একটি জীবন, এমনকি একটি সমগ্র সমাজকেও ধ্বংস করতে পারে।

পরিশেষে তিনি আহলে বাইত (আ.)–এর সীরত ও হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–এর জীবনাদর্শ অধ্যয়ন ও অনুসরণের আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, “যদি জীবনে সত্যিকারের ইমান, ধর্মীয়তা ও আধ্যাত্মিকতার স্বাদ পেতে চান—তবে হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–এর সীরত জীবনে ধারণ করুন। নিষ্কলুষ নিয়ত, ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, ধৈর্য ও দান–খয়রাত—এই শিক্ষাগুলো তাঁর মক্তব থেকেই শিখুন ও বাস্তবায়ন করুন।”

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha